কাইয়্যূমুয যামান ও ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন লক্বব মুবারক নিয়ে বিভ্রান্তির ছহীহ জবাব

 

ধারাবাহিক

 

কাইয়্যূমুয যামান” মহান আল্লাহ পাক তিনি যামানা বা যুগের রক্ষা বা নিয়ন্ত্রণকারী। আবার পবিত্র কুরআন শরীফ ও পবিত্র হাদীছ শরীফ দ্বারা প্রমাণিত যে, অনেক গাউছ, কুতুব, আবদাল বা ওলীআল্লাহ রয়েছেন যাদের মাধ্যমে মহান আল্লাহ পাক তিনি যামানাকে রক্ষা বা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। কাজেই যাদের মাধ্যমে যামানা রক্ষা বা নিয়ন্ত্রণ করা হয় তারাই “কাইয়্যূমুয যামান”। এটা নতুন কোনো লক্বব নয় স্বয়ং হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি, উনার ছেলে ইমাম মা’ছূম রহমতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম আবুল ঊলা, ইমাম হুজ্জাতুল্লাহ নকশবন্দ, হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলবী রহমতুল্লাহি আলাইহি, ফুরফুরা শরীফ উনার মুজাদ্দিদে যামান হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক্বী ফুরফুরাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও উনার ছেলে হযরত আব্দুল হাই ছিদ্দীক্বী ফুরফুরাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাদের সকলেরই লক্বব ছিলো ‘কাইয়্যূমুয যামান’।

মূলত: ‘ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন’ صاحب (ছাহিব) অর্থ সঙ্গী, বন্ধু, মালিক, কর্তা, ওয়ালা ইত্যাদি। আর كن (কুন) অর্থ হও এবং فيكون অর্থ অতঃপর হয়ে যায়। যেমন পবিত্র সূরা ইয়াসীন শরীফ উনার ৮২নং আয়াত শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

اذا اراد شيئا ان يقول له كن فيكون

অর্থ: মহান আল্লাহ পাক তিনি যখন কোন কিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছা মুবারক করেন তখন সেটাকে বলেন كن হও فيكون অতঃপর সেটা হয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ!

এ আয়াত শরীফ উনার দ্বারা মহান আল্লাহ পাক উনার কুদরত মুবারক বা ক্ষমতা বুঝানো হয়েছে। একইভাবে সমস্ত মাখলূক্বাত যে উনার কত অনুগত সে বিষয়টি ফুটে উঠেছে। (তাফসীরে বায়যাবী, কুরতুবী, তাবারী, লুবাব, মাযহারী)

পারিভাষিক অর্থে ‘ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন’ লক্বব মুবারক দ্বারা ঐ সকল হযরত আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদেরকে খিতাব বা সম্বোধন করা হয়, যাঁরা মহান আল্লাহ পাক উনার এবং উনার হাবীব হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের চরম-পরম নৈকট্যপ্রাপ্ত। যাঁদের দ্বারা মহান আল্লাহ পাক উনার كن فيكون (কুন ফাইয়াকূন) ছিফত বা গুণ মুবারক উনার বিকাশ ঘটে। উনারা যা চান মহান আল্লাহ পাক তিনি উনাদেরকে সেটাই দান করেন।

যেমন এ প্রসঙ্গে পবিত্র হাদীছে কুদসী শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عن حضرت ابى هريرة رضى الله تعالى عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان الله تعالى قال لايزال العبد يتقرب الى بالنوافل حتى احبه فاذا احببته كنت سـمعه الذى يسمع به كنت بصره الذى يبصربه كنت لسانه الذى ينطق به كنت يده التى يبطش بها كنت رجله التى يـمشى بها وان سألنى لاعطيته ولان استعاذ بى لاعيذنه.

অর্থ: “হযরত আবূ হুরায়রা রদ্বিয়াল্লাহু তা‘য়ালা আনহু তিনি বর্ণনা করেন, নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ পাক তিনি বলেন, বান্দা নফল ইবাদত করতে করতে আমার এত নৈকট্য লাভ করেন যে, আমি উনাকে মুহব্বত করি। আর আমি যখন উনাকে মুহব্বত করি, তখন আমি উনার কান হই, তিনি আমার কুদরতী কান মুবারক-এ শ্রবণ করেন। আমি উনার চক্ষু হই, তিনি আমার কুদরতী চোখ মুবারক-এ দেখেন। আমি উনার যবান হই, তিনি আমার কুদরতী যবান মুবারক-এ কথা বলেন। আমি উনার হাত হই, তিনি আমার কুদরতী হাত মুবারক-এ ধরেন। আমি উনার পা হই, তিনি আমার কুদরতী পা মুবারক-এ চলেন। যদি তিনি আমার কাছে কিছু চান, আমি উনাকে তা সাথে সাথে দিয়ে দেই। আর যদি তিনি আমার কাছে কোনো সাহায্য তলব করেন, আমি উনাকে তা পুরা করে দেই।” (বুখারী শরীফ, ফতহুল বারী, উমদাতুল ক্বারী)

‘ফাওয়ায়িদুল ফুয়াদ’ কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, ‘কারামত’ শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে মাহাত্ম্য, অসাধারণ শক্তি। কিন্তু তাছাউফের পরিভাষায় রূহানীশক্তি, যা রূহানী জজবায় বা মুহব্বতে মশগুল বীর সালিকের প্রাপ্ত পুরস্কার। যাকে মা’রিফাতের পরিভাষায়

قوة الكن

(কুওওয়াতুল কুন) বলা হয়। অর্থাৎ কুন শক্তির অধিকার পাওয়া। মূলতঃ এ কুন শক্তি মহান আল্লাহ পাক উনার নিজস্ব ব্যাপার। যাদ্বারা তিনি সমস্ত সৃষ্টি জগত ও তন্মধ্যস্থিত সবকিছুকে সৃষ্টি করেছেন। আসলে এটা ইচ্ছা ও আদেশের বহিঃপ্রকাশ।

সালিক বা মুরীদ যখন ফানাফিল্লাহ উনার মাক্বামে অর্থাৎ রূহানী জগতে মজজুবী স্বভাব হতে শান্ত হয়ে বাকাবিল্লাহ উনার মাক্বামে স্থানান্তরিত হন তখন উনাকে বিলায়েত (আধ্যাত্মিক রাজত্বের শাসনভার) দান করা হয়। আর রাজত্ব পরিচালনার জন্য উনাকে দেয়া হয় কুওওয়াতুল কুন শক্তি। ‘কুন’ শব্দের অর্থ হও। এ শক্তি দ্বারা কোন বিষয়, বস্তু ও প্রাণীকে আদেশ করা মাত্র তা কার্যকর হয়।

গাউছুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আওলিয়া হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি দীর্ঘ বারো বছর পূর্বে বরযাত্রীসহ যে ডুবে যাওয়া নৌকাটি উদ্ধার করেছিলেন তা কিংবদন্তির মত সবার মুখে মুখে। তিনিও ছিলেন

قوة الكن

তথা কুন শক্তির অধিকারী অর্থাৎ ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন মাক্বামপ্রাপ্ত ওলীআল্লাহ।

একদিন এক খ্রিস্টান ব্যক্তি উনাকে বললো, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম উনার মর্যাদা সবার ঊর্ধ্বে। তিনি মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারতেন। গাউছুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আওলিয়া হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, হে ব্যক্তি আমাদের যিনি রসূল, সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি তো মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করতে পারতেনই। এমনকি উনার উম্মতগণও তা পারেন। মনে রেখো, হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম তিনি কিন্তু قم باذن الله (মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশ মুবারকে জিবীত হও) বলে জীবিত করতেন।

আর আমি قم باذنى (আমার আদেশে জীবিত হও) বললেও জীবিত হয়। যদি প্রমাণ দেখতে চাও তাহলে বল। তখন উক্ত খ্রিস্টান ব্যক্তি একটি কবরের প্রতি নির্দেশ করে বললো “এ কবরে শায়িত ব্যক্তিকে জীবিত করুন।” তখন গাউছুল আ’যম, সাইয়্যিদুল আওলিয়া হযরত বড়পীর ছাহিব রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি সেই কবরের দিকে লক্ষ্য করে বললেন

قم باذنى

(আমার আদেশে জীবিত হও)। আর সাথে সাথে জীবিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ! (ফতহুল গাইব, রওজাতুল কাইয়ুমিয়াহ)

সুলত্বানুল হিন্দ, কুতুবুল মাশায়িখ হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনিও ছিলেন ‘ছাহিবু কুন ফাইয়াকূন’ মাক্বামপ্রাপ্ত ওলীআল্লাহ। এ বিষয়ে উনার সর্বজন বিদিত একটা কারামত উল্লেখ করা যায়। তিনি আনা সাগরের সম্পূর্ণ পানি একটা ছোট পাত্রের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। সুবহানাল্লাহ!

আরো উল্লেখ্য, বাদশাহ জাহাঙ্গীরের উজিরে আ’যম ছিল আসফ খাঁ। সে ছিল শিয়া। সে সব সময় বাদশাহকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতো।

অপর দিকে বাদশাহর দরবারে একজন মুফতী ছিলেন। উনার নাম হযরত আব্দুর রহমান রহমতুল্লাহি আলাইহি। তিনি ছিলেন আফদ্বালুল আওলিয়া, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার মুরীদ। তিনি বাদশাহকে সবসময় হক্বের উপর ইস্তিক্বামত থাকতে পরামর্শ দিতেন। একবার উজিরে আ’যম আসফ খাঁর নেতৃত্বে শিয়ারা ইউরোপ থেকে চৌদ্দ জন পাদ্রীকে নিয়ে আসলো। বাদশা যাতে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে রাজী হয়। পাদ্রীরা এসে বাদশাহর দরবারে বীজ লাগালো, তাতে সাথে সাথে গাছ হয়ে ফল হলো। আগুন ব্যতীত ভাত পাকালো। বাদশাহ সেটা বুঝতে না পেরে তাদের অনুরক্ত হয়ে গেল। খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করবে বলে এক প্রকার সিদ্ধান্ত নিলো। মুফতী হযরত আব্দুর রহমান রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বিষয়টি আফদ্বালুল আওলিয়া, ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনাকে অবহিত করলেন। ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বললেন, তাদেরকে থাকতে বল, আমি আসতেছি। তিনি বাদশাহর দরবারে এসে পাদ্রীদেরকে বললেন, “তোমরা তোমাদের কথিত কারামত দেখাও দেখি। তারা তাদের কথিত কোন কারামত দেখাতে পারলো না। ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো। আর কাকুতি-মিনতি করে বার বার ক্ষমা চাইতে লাগলো। তখন তিনি তাদেরকে দু’ভাগ হতে বললেন। তারা দু’ভাগ হলো। তিনি তাদের একভাগকে বললেন-

موتوا باذن الله

(তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশে মরে যাও) সাথে সাথে তারা মারা গেল। অপর ভাগকে বললেন, দেখতো তারা জীবিত না মৃত। তারা ভালভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললো, “তারা মৃত”। তিনি বললেন, “তোমরা তাদেরকে জীবিত কর।” তারা জীবিত করতে পারলো না। তাই তারা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ক্বদম মুবারক ধরে তাদের সঙ্গীদেরকে জীবিত করে দেয়ার জন্য কান্নাকাটি করলো। তখন ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি তাদের (মৃতদের) প্রতি লক্ষ্য করে বললেন-

قوموا باذن الله

(তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশ মুবারক-এ জীবিত হও)। সাথে সাথে তারা জীবিত হলো। এবার অপর ভাগের প্রতি লক্ষ্য করে তিনি বললেন-

موتوا باذن الله

(তোমরা মহান আল্লাহ পাক উনার আদেশে মরে যাও) সাথে সাথে তারাও মারা গেল। জীবিতদেরকে বললেন, তাদেরকে জীবিত কর। তারা তাদেরকে জীবিত করতে পারলো না। তাই তারা হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি উনার ক্বদম মুবারক ধরে তাদের সঙ্গীদেরকে জীবিত করে দেয়ার জন্য কান্নাকাটি করলো। তখন তিনি তাদেরকেও জীবিত করলেন। ইহা দেখে বাদশাহ জাহাঙ্গীরসহ সবাই তওবা করলো এবং বাইয়াত গ্রহণ করলো। ইমামে রব্বানী হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী রহমতুল্লাহি আলাইহি তিনি বলেন, “সেদিন আমার ক্বইয়ূমিয়াতের হাল এমনভাবে গালিব হয়েছিল যে, আমি যদি আসমানকে যমীন এবং যমীনকে আসমান হতে বলতাম তাহলে তাই হতো।” সুবহানাল্লাহ!

প্রসঙ্গতঃ বলতে হয়, খলীফাতুল্লাহ, খলীফাতু রসূলিল্লাহ, ইমামুল আইম্মাহ্, মুহইস্ সুন্নাহ, কুতুবুল আলম, মুজাদ্দিদে আ’যম, আওলাদে রসূল, সাইয়্যিদুনা ইমাম রাজারবাগ শরীফ উনার হযরত মুর্শিদ ক্বিবলা আলাইহিস সালাম তিনি বেমেছাল ‘কুওওয়াতুল কুন’ শক্তির অধিকারী।

 

তথ্যসুত্র: গবেষণা কেন্দ্র মুহম্মদিয়া জামিয়া শরীফ