নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অন্যান্য মানুষের মতো বলা প্রসঙ্গে

সুওয়াল: কেউ কেউ সূরা হামীম সাজদাহ উনার ৬ নম্বর আয়াত শরীফ-

قل انـما انا بشر مثلكم يوحى الى

দলীল হিসেবে গ্রহণ করে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অন্যান্য মানুষের মতো বলতে চায়। তাদের বক্তব্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য দয়া করে জানাবেন।

জাওয়াব: নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে যারা অন্যান্য মানুষের মতো বলতে চায় তারা মূলত আশাদ্দুদ দরজার জাহিল ও পথভ্রষ্ট। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে অন্যান্য মানুষের মতো মনে করা সুস্পষ্ট কুফরীর শামিল। মূলতঃ যারা কাফির কেবল তারাই হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে তাদের মতো মানুষ বলে মনে করতো।

যেমন হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনার ক্বওম এবং আদ ও ছামূদ গোত্রের লোকেরা হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের শানে বেআদবী করতে গিয়ে বলেছিলো-

ان انتم الا بشر مثلنا

অর্থাৎ আপনারা তো আমাদের মতোই বাশার (মানুষ)। (পবিত্র সূরা ইব্রাহীম শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১০)

একইভাবে ফিরআউনের লোকেরা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও হযরত হারূন আলাইহিস সালাম উনাদের ব্যাপারে বলেছিলো

انؤمن لبشرين مثلنا

অর্থাৎ আমরা কি আমাদের মতোই দু’জন বাশার তথা মানুষ উনাদের উপর ঈমান আনবো। (পবিত্র সূরা মু’মিনূন শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৪৭)

কাফির সর্দাররা হযরত নূহ আলাইহিস সালাম উনাকে বলেছিলো-

ما نراك الا بشرا مثلنا

অর্থাৎ আমরা তো আপনাকে আমাদের মতোই (বাশার) মানুষ দেখতে পাচ্ছি। (পবিত্র সূরা হুদ শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ২৭)

হযরত ছালিহ আলাইহিস সালাম উনাকে কাফিররা বলেছিলো-

ما انت الا بشر مثلنا

অর্থাৎ আপনি তো আমাদের মতোই মানুষ। (পবিত্র সূরা শুয়ারা শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ১৫৪)

হযরত হূদ আলাইহিস সালাম উনার সম্পর্কে কাফিরেরা বলেছিলো-

ما هذا الا بشر مثلكم ياكل مما تاكلون منه ويشرب مما تشربون

অর্থাৎ এই লোকটি তিনি তো আমাদের মতোই একজন মানুষ। তোমরা যা আহার করো, তিনিও তা আহার করেন এবং তোমরা যা পান করো তিনিও তা পান করেন। (পবিত্র সূরা মু’মিনূন শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৩৩)

এমনকি যিনি সাইয়্যিদুল মুরসালীন, ইমামুল মুরসালীন নূরে মুজাস্সাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্কেও কাফিরেরা বলেছিলো-

هل هذا الا بشر مثلكم افتاتون السحر وانتم تبصرون.

অর্থ: “ইনি তো তোমাদের মতো ‘বাশার’ ব্যতীত কেউ নন। তা সত্ত্বেও কি তোমরা দেখে শুনে জাদুর শিকার হবে।” (পবিত্র সূরা আম্বিয়া শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৩)

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্কে তারা আরো বলতো-

مال هذا الرسول ياكل الطعام ويمشى فى الاسواق

অর্থ: “ইনি কেমন রসূল যিনি খাদ্য খান এবং বাজারে যান।” (পবিত্র সূরা ফুরকান শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ৭)

মক্কার কাফির ওলীদ বিন মুগীরা সে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সম্পর্কে বলেছিলো-

ان هذا الا قول البشر

অর্থাৎ, ইহা তো মানুষের কথা ছাড়া আর কিছু নয়। (সূরা মুদ্দাছ্ছির শরীফ: পবিত্র আয়াত শরীফ ২৫)

কাজেই, উল্লিখিত পবিত্র আয়াতে কারীমা উনার দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, হযরত নবী-রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদেরকে নিজের মতো মানুষ বলা কাফিরদের অন্যতম একটি স্বভাব।

মূলত কাদিয়ানীরা যেমন  خاتم النبينউনার মনগড়া অর্থ ও ব্যাখ্যা করে খতমে নুবুওওয়াতকে অস্বীকার করে থাকে তদ্রুপ বাতিল আক্বীদা ও ফিরক্বার লোকের পবিত্র কালাম উনার পবিত্র সূরা হামীম সাজদা উনার আয়াত শরীফ-

قل انـما انا بشر مثلكم يوحى الى

উনার মনগড়া অর্থ ও ব্যাখ্যা করে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে তাদের মতো মানুষ বলে থাকে। নাউযুবিল্লাহ!

প্রকৃতপক্ষে পবিত্র আয়াত শরীফ উনার সঠিক অর্থ ও মর্ম হলো- “হে আমার হাবীব ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! আপনি ওই মুশরিকদের বলে দিন যে, আমি তোমাদের মেছাল (মত) একজন মানুষ, (হাক্বীক্বত আমি একজন রসূল; যার কারণে) আমার নিকট ওহী এসে থাকে।

পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যে কি মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব উনাকে আমাদের মতো বলা হয়েছে? মোটেও নয়। কারণ উক্ত পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যেই

يوحى الى

অর্থাৎ ‘আমার নিকট ওহী মুবারক এসে থাকে’ এ বাক্যটি হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সকল মানুষ থেকে আলাদা করে দিয়েছে। যেহেতু অন্যান্য মানুষের নিকট ওহী মুবারক আসে না।

এর প্রমাণ হচ্ছে حيوان (হায়ওয়ান) শব্দটি। যেমন ‘হায়ওয়ান’ বা প্রাণী বলতে মানুষকেও বুঝায় এবং অন্যান্য জীব-জন্তুকেও বুঝায়। তবে কি কেউ একথা বলবে যে, গরু-ছাগল, ঘোড়া-গাধা ইত্যাদিও আমাদের মতো ‘হায়ওয়ান’।

মূলত মানুষ হায়ওয়ান বটে কিন্তু গরু-ছাগল, ঘোড়া-গাধা প্রভৃতি হায়ওয়ানের মতো নয়। কেননা মানুষ হলো ‘হায়ওয়ানে নাতিক’ অর্থাৎ বাকশক্তিসম্পন্ন জীব। মানুষ বিবেক, জ্ঞান ও বাক শক্তির অধিকারী। যেরূপ এ নাতিক্ব বা ‘বাকশক্তি সম্পন্ন’ শব্দটি মানুষকে অন্যান্য জীব-জন্তু হতে পৃথক করে দিয়েছে তদ্রুপ يوحى الى (আমার নিকট ওহী মুবারক এসে থাকে) পবিত্র বাক্যখানা নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক করে দিয়েছে।

বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফ উনাদের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে, হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি ‘ইহসান’ সম্পর্কে জানতে চাইলে তার উত্তরে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বললেন-

ان تعبد الله كانك تراه فان لـم تكن تراه فانه يراك

অর্থাৎ ইহসান হলো এমনভাবে মহান আল্লাহ পাক উনার ইবাদত করো অর্থাৎ মুসলমানের প্রতিটি মুহূর্তই যেহেতু ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত সেহেতু প্রতিটি মুহূর্ত এমনভাবে অতিবাহিত করো যেনো তুমি মহান আল্লাহ পাক উনাকে দেখছো, যদি দেখতে না পাও তাহলে ধারণা করো যে তিনি তোমাকে দেখছেন।

এ পবিত্র হাদীছ শরীফ থেকে হযরত মুহাদ্দিছীনে কিরাম ইহসানের দুটি স্তর বর্ণনা করেছেন। এক. বান্দা মহান আল্লাহ পাক উনাকে দেখে দেখে ইবাদত করবে। দুই. বান্দাকে মহান আল্লাহ পাক দেখছেন এ ধারণা করে বান্দা ইবাদত করবে। এ দুঅবস্থা ব্যতীত ইবাদত করা হলে সে ইবাদত মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট কবূলযোগ্য হবেনা।

এ পবিত্র হাদীছ শরীফ প্রমাণ করছে, বান্দা যমীনে মহান আল্লাহ পাক উনাকে দেখবে। এখন কিভাবে দেখবে সে বর্ণনা অন্য পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে রয়েছে এবং হযরত ইমাম-মুজতাহিদ-আওলিয়ায়ে কিরাম রহমতুল্লাহি আলাইহিম উনাদের কিতাবাদিতে উনারা সেটা বর্ণনা করেছেন। তাহলো- মিছালী ছূরত মুবারক উনার বর্ণনা। কারণ আমাদের আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনাদের আক্বীদা হলো, যমীনে মহান আল্লাহ পাক উনাকে হাক্বীক্বী ছূরত মুবারক-এ কেউই দেখবে না। মিছালী ছূরত মুবারক-এ দেখতে পাওয়া বহু বর্ণনার মধ্যে একটি বর্ণনা হলো বাশারী ছূরত মুবারক-এ দেখা।

এখন মহান আল্লাহ পাক উনাকে মিছালী বাশারী ছূরত মুবারকে দেখে কী একথা বলা শুদ্ধ হবে যে, মহান আল্লাহ পাক তিনি মানুষের মতো? নাঊযুবিল্লাহ!

যদি মহান আল্লাহ পাক উনাকে মিছালী বাশারী ছূরত মুবারক-এ দেখে মানুষের মতো বলা শুদ্ধ না হয় তাহলে মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে মিছালী বাশার ছূরত বা আকৃতি মুবারক উনার কারণে অন্যান্য মানুষের মতো বলা শুদ্ধ হবে কি করে?

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত রয়েছে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি সৃষ্টির পর থেকে যমীনে আগমনের পূর্ব পর্যন্ত শুধুমাত্র নূর মুবারক উনার ছূরত বা আকৃতি মুবারক-এ ছিলেন। আর হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারাও নূর মুবারক দ্বারা সৃষ্টি। তাই বলে কি কোন ফেরেশতা কখনও একথা বলেছেন যে, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি উনাদের মতো? বললে কি সে কথা শুদ্ধ হতো? অবশ্যই না। তাহলে বাশারী ছূরত মুবারক উনার কারণে তিনি অন্য মানুষের মতো হন কি করে?

নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার আনুষ্ঠানিক নুবুওওয়াত প্রকাশের তেইশ বছর যিন্দিগী মুবারক-এ হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম তিনি চব্বিশ হাজার বার সাক্ষাৎ করেছেন। এরমধ্যে তিনি অনেক সময় ছাহাবী হযরত দাহইয়াতুল কলবী রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার মুবারক ছূরত বা আকৃতিতে সাক্ষাৎ করেছেন। আর তাই পবিত্র সূরা মারইয়াম শরীফ উনার ১৭ নম্বর আয়াত শরীফ উনার মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তিনি হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনার মানব আকৃতি ধারণ করার কথা উল্লেখ করেছেন। এই পবিত্র আয়াত শরীফ উনার মধ্যেও হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনার ক্ষেত্রে ‘বাশার’ বা মানব শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এখন বাশার ছিফতের অধিকারী হওয়ার কারণে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে যারা তাদের মতো সাধারণ মানুষ বলছে, তারা তাহলে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম উনাকে সাধারণ মানুষের মতো বলছে না কেন?

একইভাবে জিনেরাও মানুষের ছূরত ধারণ করে চলাফেরা করে, মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করে সেজন্য তাদেরকে কি মানুষ বলা শুদ্ধ হবে? কস্মিনকালেও নয়।

উল্লেখ্য, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার শান মুবারক সম্পর্কে কটূক্তি করে যারা বলছে যে, তিনি নাকি তাদের মতোই সাধারণ মানুষ। নাঊযুবিল্লাহ! যারা এরূপ জঘন্য উক্তি করছে তারা কি কখনও তাদের দলের আমীর, উস্তাদ ও পিতা-মাতার দাঁতকে কুকুরের দাঁতের মতো বলবে? যদিও কুকুরের দাঁত তাদের আমীর, মুরুব্বী, উস্তাদ ও পিতা-মাতার দাঁতের চেয়েও শক্ত।

আরো উল্লেখ্য, জগৎ কুখ্যাত নমরূদ, শাদ্দাদ, কারূন, ফিরআউন, আবূ জাহিল, আবূ লাহাব এরাও তো মানুষ, তাহলে মাঝে মাঝে ওইসব কুলাঙ্গাররা নিজেদের বড়ত্ব প্রকাশ করার জন্য বলুক যে, সে এবং তাদের আমীর ও মুরুব্বী গং নমরূদ, শাদ্দাদ, কারূন, ফিরআউন, আবূ জাহিল, আবূ লাহাবের মতোই।

উপরন্তু ‘মিছলু’ বা ‘মতো’ শব্দটির জন্য সবকিছুকেই যদি একাকার করতে হয় তাহলে পৃথিবীটা তো কমলা লেবুর মতোই গোলাকার। ফলে তারা নিজেদের ঘরের দেয়াল চাটুক আর বলুক যে তারা কমলা লেবু খাচ্ছে। কারণ, তাদের ঘরটাতো পৃথিবীর ভিতরেই। মহান আল্লাহ পাক কত চমৎকারইনা বলেছেন-

من اتخذ الـهه هواه واضله الله على علم وختم على سمعه وقلبه وجعل على بصره غشاوه

অর্থ: “যে ব্যক্তি তার খেয়াল-খুশিকে স্বীয় উপাস্য স্থির করে নেয়, মহান আল্লাহ পাক তিনি জেনে শুনেই তাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার কান ও অন্তরে মোহর মেরে দেন এবং তার চোখের উপর আবরণ বা পর্দা রেখে দেন।” অর্থাৎ সে নফসের পায়রবী করার কারণে পথভ্রষ্ট হয়ে যায় অতঃপর তার কান ও অন্তরে মহর পড়ে যায় এবং চোখে পর্দা পড়ে যায়।

ফলে, এদের পক্ষে হক্ব জানা, বুঝা, অনুধাবন করা এবং তা মানা ও গ্রহণ করা কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।